ভয়াবহ বন্যার কবলে বাংলাদেশ । ফেনীর মুহুরি নদীর পানি প্রবাহের মাত্রা গত ৪০ বছরে সর্বোচ্চ আকার ধারণ করেছে,প্লাবিত হয়েছে এই অঞ্চলের প্রায় সকল এলাকা।একই ঘটনা কুমিল্লাতেও।ডুবে গেছে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক এর বিভিন্ন অংশ।প্রচুর বৃষ্টিপাত এর পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশ এর অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যেকার বাঁধ খুলে দেয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি যার মধ্যে ৫৩ টি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।এই নদীগুলোর উপর দেয়া বাধগুলোই কি আমাদের বন্যা পরিস্থিতির জন্য দায়ী?
১৯৯৭ সালে বিশ্বের দেশগুলোকে সাথে নিয়ে অভিন্ন নদীগুলোর পানিপ্রবাহ সম্পর্কিত একটি কনভেশন আয়োজন করে জাতিসংঘ যেখানে একাধিক দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো উপর কিছু ধারা উত্থাপন করা হয় এবং সেটি পাশও হয়।কিন্তু কনভেশন এ ধারাগুলো পাশ হলেও সেটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হতে সময় লাগে ১৭ বছর।
ধারাগুলো ছিল-
১.অভিন্ননদীগুলো কোনো একক দেশ এমনভাবে ব্যবহার করতে পারবে না যা অপর দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।যদি ক্ষতিগ্রস্ত করেই থাকে তবে ভুক্তভোগী দেশ ক্ষতিপূরণ এর জন্য মামলা করতে পারবে।
২.অভিন্ন নদীগুলোর যে স্বাভাবিক প্রবাহ তাতে এমন কিছু করা যাবে না যেন ঐ স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।কৃত্রিমভাবে নদীর পানি অন্যদিকে প্রবাহিতও করা যাবে না।এক নদীর পানি অন্য নদীতে নিয়েও যাওয়া যাবে না।
২.অভিন্ন নদীগুলোর যে স্বাভাবিক প্রবাহ তাতে এমন কিছু করা যাবে না যেন ঐ স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।কৃত্রিমভাবে নদীর পানি অন্যদিকে প্রবাহিতও করা যাবে না।এক নদীর পানি অন্য নদীতে নিয়েও যাওয়া যাবে না।
৩.নদীর পানি এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে নদী ক্ষতির শিকার না হয়।উভয়দেশ নায্যতার ভিত্তিতে নদী প্রবাহ ব্যবহার করবে এবং নদী সংরক্ষণ এর জন্য একসাথে কাজ করবে
এথেকে বোঝা যায় ভারতের এমন কোনোকিছু করার অধিকার নেই যাতে অভিন্ন নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশ শুকিয়ে মরে যায়।কিন্তু ভারত এই কাজটিই বার বার করে আাসছে ৫৩ টি নদীর মধ্যে ৪৭ টি নদীর গতিপথে ছোট-বড় ৫ শতাধিক বাধ নির্মান করেছে ভারত। এই বাধের কারণে নদী প্রবাহ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে ফলে বাংলাদেশ এর নদনদী খালবিল শুকিয়ে যাচ্ছে,মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে।ভারত অবৈধভাবে একাধিক বাধ নির্মান করে প্রতিনিয়ত নদীর গতিপথ পরিবর্তন করেছে এবং এটি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
তিস্তা নদী হলো বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী।সে তিস্তা নদীর সিকিম থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ পথে প্রায় ৫-৬ টি বাধ রয়েছে।প্রতিটি বাঁধেই খাল কেটে পানি অনত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে। অর্থাৎ উপরের অংশ থেকে এত পরিমাণে পানি সরিয়ে নেয়া হয়েছে যে বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী ভারতীয় যে বাধটি রয়েছে সেখানেই পানি সংকট দেখা দিয়েছে ফলে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা একেবারে শূন্য চরে পরিণত হয়েছে।বিভিন্ন তথ্যমতে জানা যায় ভারত নদীর ৮০% পানিই বাঁধের মাধ্যমে অনত্র সরিয়ে নিয়েছে।শুধু তিস্তাই নয় উত্তর অঞ্চলের ধরলা,দুধকুমার, মহানন্দা,করতোয়া এসব নদীর উপরের অংশেও বাঁধ দিয়েছে ভারত এবং বিভিন্ন খালের মাধ্যমে ভারতের ভেতরে আন্তনদীর সংযোগ স্থাপন করেছে।
আন্ত নদী সংযোগ এর আওতায় তিস্তার পানি দেয়া হচ্ছে মহানন্দায়,মহানন্দার থেকে সে পানি যাচ্ছে ডাহুকে আর ডাহুক থেকে পশ্চিম বঙ্গের সেচ কাজে। কিন্তু এই তিস্তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর চুক্তিই করা হয়নি।মমতা ব্যনার্জি জোড় গলায় বলেন যে তিস্তায় জল নেয় কিন্তু স্যাটেলাইট ইমেজে এ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় তিস্তায় কতটুকু জল আছে। একই ঘটনা পদ্মানদীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে,সীমান্ত থেকে ১৬.৫ কি.মি দূরে ফারাক্কায় বাধ নির্মান করে গঙ্গার বেশিরভাগ পানি প্রবাহিত করা হচ্ছে কলকাতার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথী নদী দিয়ে।১৯৭৪ সালে ফারাক্কা বাধ কার্যকর হওয়ার পর থেকেই আমাদের দেশের পদ্মা অংশে পানি কমে আসে,তখন থেকে পদ্মার আশে পাশের শাখানদীগুলোতে পানি সংকট লক্ষ্য করা যায়।জঘন্যতম সত্য হলো গঙ্গায় শুধু মাত্র ফারাক্কা বাধই নয় উপরের দিকে আরও কয়েকটি বাধ নির্মাণ করেছে ভারত। এরকম ভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করা বেশিরভাগ নদীর উপরের অংশে বাধ দিয়ে পানি অনত্র স্থানান্তর করে যাচ্ছে ভারত।ফলে বাংলাদেশ অংশ শুষ্ক মরুতে পরিণত হচ্ছে।
ভারত শুষ্ক মৌসুমেই শুধুমাত্র বাঁধ এর মাধ্যমে নদীর উপরের অংশের পানিগুলো নিজের দেশের কাজে ব্যবহার করে থাকে।যার ফলে সে মৌসুমে আমাদের দেশের নদীগুলোর প্রবাহ একদমই কমে যায়। এমন অবস্থা দীর্ঘদিন যাবৎ চলার কারণেই নদীর পানি ধারণ ক্ষমতাও কমে এসেছে।ফলে ভারত বর্ষা মৌসুমে যখন বাধ খুলে দেয় আমাদের দেশের অংশের নদীগুলো পর্যাপ্ত পানি ধারণ করতে পারে না এবং এই কারণেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যার। তাছাড়া বাংলাদেশকে আগে থেকে কিছু না জানিয়েই ভারত বাধগুলো খুলে দেয়। ফলে দেখা যায় কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা প্রবল বন্যার শিকার হয়ে থাকি।গত ২০২১ সালেও এমন চিত্র দেখতে পাই আমরা।দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল।এবারও গোমতী নদীর যে বাধ তা আমাদের না জানিয়েই হঠাৎ খুলে দেয় যার ফলে এমন ভয়ংকর বন্যার কবলে পরেছি আমরা।এই না জানিয়েছে বাধ খুলে দেয়ার যে ব্যাপারটি স্পষ্ট করে যে ভারত বাংলাদেশ এর ক্ষতি চায়। তাছাড়া আমাদের দেশের নদী ব্যবস্থাপনাতেও ব্যাপক সমস্যা রয়েছে।নদীর নব্যতা ধরে রাখতে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি আমাদের।এছাড়া খাল-বিল ভরাট করে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছি,অপরিকল্পিত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানের মাধ্যমেও নদীর ক্ষতি করছি আমরা।ফলে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পরছি আমরা।আমরা সুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটে থাকলেও বর্ষার মৌসুমে অতিরিক্ত পানি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি ভারতের এই বাধ নিয়ে করে আসা কারসাজির ফলেই।কিন্তু এটি স্পষ্টত যে ২০২৪ এর এই ভয়াবহ বন্যার জন্য ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ার নিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।