বর্তমানে বহুল আলোচিত এক নাম আয়নাঘর।শেখ হাসিনার পতনের পর ‘আয়নাঘর’ আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। সেখান থেকে ইতোপূর্বে তিনজন বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। গত দুই দিন রাজধানীর কচুক্ষেতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া মানুষের খোঁজে ভিড় জমাচ্ছেন স্বজনরা।
আয়নাঘর কী?
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম আয়নাঘর। ধারণা করা হয়, এখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে। আয়নাঘরটি বাংলাদেশের ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।
আয়নাঘর শুনতে যতটা সাদামাটা ততটাই রহস্যময়। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি এই আয়নাঘরেই রাখা হতো গুম করে রাখা মানুষদেরকে। আলো বাতাসহীন একটি কক্ষ। সেখানে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়িয়ে চলে ফ্যান।
হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হন ৪০২ জন মানুষ। এ তথ্যটি প্রকাশ করে ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেফতার অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০৩ জন এখনো গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌন অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয় এসব মানুষদের গুম করে রাখা হয় আয়নাঘরে।
আয়নাঘরে যারা বন্দি থেকেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়।
এছাড়াও আয়নাঘর থেকে সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশী ব্যারিস্টার এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম, সাবেক সামরিক জেনারেল এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা।
বাংলাদেশ বেসরকারি একটি সংবাদ মাধ্যম থেকে ধারণা করছে, যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম আরও বেশ কিছু নির্যাতন ও আটক স্থান থাকতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে সদ্য দেশ থেকে পলায়ন করা শেখ হাসিনা বিরুদ্ধ মত সহ্য করতে পারছিলেন না। আর সেই কারণে রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য তৈরি করেছিলেন আয়না ঘর। যা ছিল রাজনৈতিক বন্দিদের কাছে ত্রাস বা বিভীষিকাময়। হাসিনার তৈরি বিরুদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের গুমঘর। প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ করার একটি উপায়। সারাদেশে ডিজিএফআই’র ২৩টি গোপন আটক কেন্দ্র রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি রয়েছে ঢাকায়।
২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর, ২০০৯ সাল থেকে তার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে
আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন সাবেক বন্দীর ভিডিও বার্তা থেকে সেখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।আয়নাঘরের ভিতরের পরিবেশটা বাহিরের জগৎ থেকে একদমই আলাদা।আলো বিহীন কক্ষ।কক্ষের মধ্যে চালানো হতো উচ্চ শব্দের পাখা।যেন ভিতরের কোনো প্রকার শব্দ বাহিরে বের হতে না পারে। সেখানকার বন্দীদের প্রতিনিয়ত করা হত আমানবিক নির্যাতন। ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত আশনাঘরের দুইটা অংশ পুরাতনটিতে ১৬ টি কক্ষ আর নতুনটিতে ১০টি কক্ষ।আয়নাঘরের কক্ষগুলো মধ্যে কয়েকটি সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ ছিল যেখানে চালানো হত পৈশাচিক নির্যাতন। সাবেক বন্দী সেলিম জানান ভুল তথয়ের কারণে সাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তাকে সহ্য করতে হয়েছিল নির্যাতন।
এই আয়নাঘরের দেয়ালে রয়েছে অনেক মানুষের আর্তনাদ খোদাই করা।এখানে বন্দীদের সব সময় চোখ বেঁধে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে নিয়ে যাওয়া হত। সাবেক বন্দী ব্যারিস্টার আহমেদ বীন কাশেম জানান বন্দী থাকা অবস্থায় তাকে তিন বেলা দূর্গন্ধযুক্ত বাটিতে খাবার দেয়া হত যা একজন মানুষ এর পক্ষে খাওয়া একেবারেই অসম্ভব। মুক্তি পাওয়া বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী তার আয়নাঘরের থাকা কালীন অবস্থার কথা বণর্না করতে গিয়ে জানান তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয়নি কখনোই এমনকি তাকে আযান পর্যন্ত শুনতে দেয়া হয়নি। এখানে বন্দী করা সকলকেই সবসময়ের জন্য যে বন্দী করে রাখা হয়েছে এমনটাও নয়।কয়েকজন কে কিছু বছর নির্যাতন এর পর মিথ্যা মামলা দিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হত,তাদের এমন ভাবে উপস্থাপন করানো হত যেন তাদের তখনই মাত্র বন্দী করা হয়েছে।আর কিছু মানুষকে সেই আয়নাঘরেই মেরে ফেলা হত।
আয়নাঘর থেকে খুব কম বন্দি মুক্তি পেয়েছে। তবে কিছু বন্দিকে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়। অনেকেই আবার এনকাউন্টারের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে এজাতীয় ঘটনার তদন্ত প্রায় হয় নি বললেই চলে। আয়নাঘরে রাখা অনেকেই দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। তারপর লাস সরিয়ে দেওয়া হয়। যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের খাতা কলমে কোনো তথ্য রাখা হয় না। আর যারা হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন তারাই আয়নাঘরের দায়িত্ব পেতেন। আয়নাঘরের বন্দিদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করা বা যোগাযোগের কোনও আইন ছিল না।
এমনই এক অমানবিক বন্দীশালায় এখনও আটক আছে অনেক মানুষ, আমরা আাশা রাখতে পারি খুব শীঘ্রই জীবিত সকল বন্দী মুক্তি পাবেন